নিজস্ব প্রতিবেদক:
উচ্চ আদালতের নির্দেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে আগেই নিবন্ধন হারিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এবার সরকারের নির্বাহী আদেশে দলটি নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আজই নিষিদ্ধ করা হবে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক অনু বিভাগ থেকে এ-সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হবে। অত্যন্ত সতর্কতা ও গোপনীয়তার সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার গভীর রাত পর্যন্ত এ শাখার কর্মকর্তারা সচিবালয়ে এ বিষয়ে কাজ করেন। যদিও এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি কর্মকর্তারা। রাজনৈতিক অনু বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত সচিব টিপু সুলতানের মোবাইল ফোন গভীর রাত পর্যন্ত বন্ধ ছিল। এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলমও।
মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্টরা জানান, গত রাতেই এ-সংক্রান্ত নথি তৈরি করা হয়েছে। আজ এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনের জন্য নথি পাঠানো হবে। অনুমোদন মিললে আজই আদেশ জারি করা হবে।
আইনকানুন দেখেশুনেই জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধের প্রস্তাব নথিতে তোলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে– দেশ, জনগণ ও রাষ্ট্রের জন্য তাদের কর্মকাণ্ড ও নৃশংসতা হুমকিস্বরূপ। সাম্প্রতিক সময়ে তারা ব্যাপকভাবে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে এবং জঙ্গিবাদী কায়দায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জানমালের ক্ষতিসাধন ও বিনাশে লিপ্ত হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা, সহিংসতা ও রাষ্ট্র এবং জনগণের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠা যে কোনো ধরনের সংগঠন নিষিদ্ধ করার অধিকার রাখে সরকার। আইনি সে ক্ষমতা রয়েছে।
গতকাল বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সরকারের সাত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এক বৈঠকে অংশ নেন। এতে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে বৈঠকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, র্যাবের মহাপরিচালকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে দুপুরে নিজ কার্যালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধিতাকারী দল হিসেবে জামায়াত ও তাদের সহযোগী সংগঠন শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। কোন প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ হবে, সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
গত সোমবার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৪ দলের সভায় জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত হয় ১৪ দলীয় জোট। তবে জামায়াতকে নিষিদ্ধের আলোচনা গত ১০ বছর ধরেই চলছে। এখন কোন প্রক্রিয়ায় কোন কারণে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে গতকাল আইনমন্ত্রী বলেন, গত ১৬ থেকে ২০ জুলাই কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে যে নৃশংসতা চালানো হয়েছে, সেখানে আন্দোলনকারীরা বলেছেন যে তারা সহিংসতার মধ্যে নেই। আমাদের কাছে তথ্য-উপাত্ত আছে, এই জামায়াত-শিবির এবং বিএনপি-ছাত্রদলের যারা জঙ্গি, তারাই এই সহিংসতা করেছে। এই দলটাকে যদি নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা ও দেশের পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
১১ বছর আগে নিবন্ধন হারায় দলটি
২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন কমিশন থেকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা নিয়ে ২০০৯ সালে রিট করেন তরীকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ। ফলে ধর্মভিত্তিক এই দলটির জাতীয় নির্বাচন করার পথ বন্ধ হয়ে যায়। ওই রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করা হলে একই বছরের ৫ আগস্ট আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত তা খারিজ করে দেন। এর পর ওই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে দলটির পক্ষ থেকে লিভ টু আপিল দাখিল করা হয়। ওই আপিলও গত বছরের ১৯ নভেম্বর খারিজ করেন আপিল বিভাগ। ফলে দল হিসেবে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিতে পারেনি জামায়াত।
আগেও একাধিকবার নিষিদ্ধ হয়েছে জামায়াত
পাকিস্তানে দু’বার এবং ভারতে চারবার সাময়িক নিষিদ্ধ হয়েছিল জামায়াত। বাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল জামায়াত। ১৯৮৬ সালে প্রথম দেশে নির্বাচনে অংশ নেয় জামায়াত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। এর পর থেকে ‘যুদ্ধাপরাধী দল’ হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিও জোরালো হয়ে ওঠে। একে একে যুদ্ধাপরাধ মামলার ৬৬টি রায় হয়েছে। কিন্তু অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করা হয়নি।