নিজস্ব প্রতিবেদক:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সারা দেশে চলছে 'কমপ্লিট শাটডাউন'। চলমান কোটা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা দেশের বিভিন্ন জায়গায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চলছে এই শাটডাউন।
বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বেলা ১১টা থেকে যাত্রাবাড়ী শনির আখড়া ও রায়েরবাগ এলাকায় পুলিশ, র্যাব ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ত্রিমুখী সংঘর্ষ শুরু হয়েছে।
জানা যায়, বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকাল থেকেই সড়কে অবস্থান নেয় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ সময় যাত্রাবাড়ী থানার সামনে দুই যুবকের পায়ে গুলি করে র্যাব। বেলা ১১টা বাজতেই নেমে আসে সাধারণ শিক্ষার্থী স্থানীয় এলাকার জনগণ।
এ সময় আন্দোলনকারীরা সড়কে অবস্থান নিতে গেলে টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে থাকে পুলিশ। আন্দোলনকারীরা পিছু না হটে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে।
সকাল থেকে রায়েরবাগ ও শনিরআখড়া এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট অবরোধ করে সাইনবোর্ড থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত এলাকায় সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলকারীরা।
তাদের অবরোধের কারণে এই মহাসড়ক ব্যবহার করে যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ করতে বা বের হতে পারছে না। মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া এই অবরোধ এখনো চলছে। মধ্যরাত থেকে শনিরআখড়া এলাকায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় গতরাতের অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে যাত্রাবাড়ী অংশে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
যাত্রাবাড়ী অবরুদ্ধ, রাজধানীতে গণপরিবহন কম : সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা বৃহস্পতিবার যে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ রেখেছেন, সেই কর্মসূচির সকালে রাজধানীতে গণপরিবহনের সংকট দেখা দিয়েছে। তাতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন কর্মজীবী মানুষ।
এদিকে আন্দোলনকারীরা রাজধানীর শনির আখড়া ও মাতুয়াইলে সড়ক অবরোধ করে রাখায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল ব্ন্ধ হয়ে গেছে।
বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকালে যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া ও মাতুয়াইল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শনির আখড়া এবং মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সামনের সড়ক অবরোধ করে রেখেছে আন্দোলনকারীরা। সেখানে গাছের ডাল, টায়ার জ্বালিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে সড়কে। এতে ওই সড়ক দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ এবং বের হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
ওই সড়কে রিকশা বা মোটরসাইকেলও চলতে দেওয়া হচ্ছে না। লোকজন হেঁটে গন্তব্যে যাচ্ছেন।
যাত্রাবাড়ী থেকে বের হওয়ার পথে মহাসড়কের একটি পার্শ্বসড়ক ধরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে বেশকিছু যানবাহন। তবে সেগুলোও আটকে আছে।
বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকাল সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কোনো সদস্যকে দেখা যায়নি। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বৃহস্পতিবার সকালে বলেন, যাত্রাবাড়ী ও শনিরআখড়া ছাড়ার ঢাকার আর কোনো সড়কে সকাল পর্যন্ত আন্দোলনাকারীরা বসেনি। কোনো সড়কও অবরোধ করা হয়নি।
যানবাহন কম, দুর্ভোগ চরমে : বৃহস্পতিবার অফিস সময়ে বিভিন্ন সড়ক প্রায় ফাঁকা দেখা গেছে। কিছু বাস এবং ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচল করছে। বাস না পেয়ে যাত্রীরা হেঁটে গন্তব্যে যাচ্ছেন। অনেকে পিকআপ, ট্রাকে উঠে পড়েছেন।
পল্টন, তোপখানা রোড, বিজয়নগর, কাকরাইল, মালিবাগ, মৌচাকে গণপরিবহন কম থাকায় অফিসমুখী মানুষকে পায়ে হেঁটে চলতে দেখা গেছে।
কাকরাইলে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক আবদুল করিম বলছিলেন, বিভিন্ন মোড়ে দেখবেন- অনেকে দাঁড়িয়ে আছে বাসের জন্য। কিন্তু বাস রাস্তায় কম। সিএনজিতেও উঠতে চায় না। আমরা কাস্টমার কম পাচ্ছি।
শান্তিনগর থেকে মতিঝিলে হেঁটে যাচ্ছিলেন বীমা কর্মী সোহরাব হোসেন।
তিনি বলেন, রাস্তায় বেরিয়ে দেখি, যানবাহন কম। একজন রিকশা চালককে জিজ্ঞাসা করলাম, সে জানাল, ‘স্যার আজকে ছেলে-পেলেদের হরতাল। গাড়িতে গেলে বিপদে পড়বেন’। সেজন্য হেঁটে যাচ্ছি।
ফকিরেরপুল, রাজউক অ্যাভিনিউয়ের মতো ব্যস্ততম সড়কে সরকারি গাড়ি, পুলিশের যানবাহন ছাড়া গণপরিবহন একেবারেই কম দেখা গেছে।
কুড়িল বিশ্বরোড, শেওড়া, এমইএস, কাকলী, চেয়ারম্যানবাড়ি ও মহাখালীর আমতলী ঘুরে দেখা গেছে, জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়া মানুষ বাসের অপেক্ষায় আছেন।
এমইএস বাসস্ট্যান্ড থেকে বনানী যেতে বাসের অপেক্ষায় থাকা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসিন্দা সুকোমল সরকার বলেন, সকাল আগে আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত বাসের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।
কিন্তু বাস আসে না। আসলেও ভিড়ের কারণে তাতে ওঠা যায় না। অন্যদিন এ সময় শতশত বাস যায়। এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না।
বাস না পেয়ে ঢাকার খিলক্ষেত থেকে হেঁটে মহাখালী রওনা হয়েছিলেন কাউসার আহমেদ নামে এক যুবক। পরে কুড়িল বিশ্ব রোডে এসে আরও অনেকের দেখাদেখি একটি খালি পিকআপে ওঠেন তিনি।
কিন্তু পিকআপ বনানী পর্যন্ত এসে নামিয়ে দিয়েছে। পরে বনানী থেকে মহাখালী পর্যন্ত হেঁটে এসেছি, বলছিলেন বেসরকারি চাকুরে কাউসার।
ঢাকা-নেত্রকোণা রুটের একটি বাস সকালে যাত্রী নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে। ওই বাসের চালকের সহকারী আবুল কালাম বলেন, আমরা ভোরে রওনা হইছি। রাস্তায় কোনো গ্যাঞ্জাম দেখি নাই। এখন ফেরত যাইতে পারুম কি না জানি না।
ঘটনার পরম্পরা : সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে মঙ্গলবার সারা দেশে কোথাও কোথাও আন্দোলনকারী এবং সরকার দলীয় সংগঠন ও পুলিশের ত্রিমুখী সংর্ঘের মধ্যে ছয়জন নিহত হন। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বুধবার সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষার্থীরা হল ছাড়া শুরু করেন।
এর মধ্যেই মঙ্গলবার নিহতদের স্মরণে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো বুধবার ঢাকায় গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাও গায়েবানা জানাজা ও প্রতীকী কফিন মিছিল করার সময় তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়।
বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোটা সংস্কারের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সহিংসতার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
এরপর রাত পৌনে ৮টার দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষে খুনের দায়ে জড়িতদের বিচার ও সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে বৃহস্পতিবার সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচি ঘোষণা আসে আন্দোলনকারীদের পক্ষে।
এদিকে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘাতের খবরের মধ্যে শনির আখড়ায় সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে বিকাল ৫টার দিকে। সেখানে আশপাশের মানুষ বিক্ষোভ দেখানোর সময় পুলিশের ওপর ‘অতর্কিত হামলা’ চালায়। পরে রাতে দ্বিতীয় দফা সংঘাতের সময় আগুন দেয় টোল প্লাজাসহ আশপাশের বিভিন্ন স্থানে।
সরকারপ্রধানের বিচারবিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা, জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি এবং ছাত্রসমাজ আদালতে ন্যায়বিচার পাবে, এমন আশাবাদের পরও সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে শিক্ষার্থীদের কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা উদ্বেগ তৈরি করেছে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় রাজধানীতে বায়তুল মোকররমের দক্ষিণ গেইটে সমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের।
অপরদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে ‘সর্বাত্মক’ সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। পুলিশও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর মত সহিংস কর্মকাণ্ড পরিহার করতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বৃহস্পতিবার দেশের বিভিন্ন স্থানে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।