আশরাফাফুল নয়ন :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার রচনায় বিশ্বকবি হলেও বরেন্দ্রভূমির সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন উন্নয়নের নায়ক, বরেন্দ্র অঞ্চলের উন্নয়নের রূপকার। এ অঞ্চলে উন্নয়নের বীজ প্রথম বপন করেছিলেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বরেন্দ্রভূমির এক বৃহৎ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মাঝে তার জনহিতৈষী কর্মকাণ্ড দিয়ে আজও তিনি বরণীয়। যদিও জীবনের উপসংহারে আত্মোপলব্ধি থেকে তিনি মনে করতেন তার একটাই পরিচয়, শুধু কবি।
জমিদারি দেখভালের জন্য পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে প্রথম ১৮৯০ সালে পূর্ববঙ্গে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপর টানা প্রায় ১০ বছর (১৮৯০-১৯০০) রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসরে জীবন অতিবাহিত করেছেন, গ্রহণ করেছেন নানা কর্মোদ্যোগ, প্রতিষ্ঠা করেছেন অনেক প্রতিষ্ঠান।
একাধিক ইতিহাসবিদের তথ্য থেকে জানা যায়, পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং ওড়িশায় বিশাল জমিদারি ১৮৩০ সালে ক্রয় করেন রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর। পূর্ববঙ্গে এই জমিদারির আওতায় ছিল নদিয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার বিরাহিমপুর (সদর শিলাইদহ), পাবনা জেলার শাহজাদপুর পরগণা (সদর শাহজাদপুর; বর্তমান সিরাজগঞ্জের অন্তর্গত) এবং রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগনা (সদর পতিসর; বর্তমান নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার অন্তর্গত)। এছাড়া সামান্য কিছুদিনের জন্য পাবনার পত্তনী তালুক তরফ চাপড়ি, রংপুরের স্বরূপপুর এবং যশোরের মোহাম্মদশাহীতে ছোট ধরনের জমিদারি ছিল। দ্বারকানাথের পর জমিদারির দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন ধার্মিক ও তত্ত্বজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ; বিষয়-সম্পত্তির প্রতি তার তেমন আগ্রহ ছিল না। তিনি ঠাকুর পরিবারের জমিদারির প্রসার ঘটাতে না পারলেও ভূ-সম্পত্তির পরিচালন ব্যবস্থা সুসংহত করেছিলেন।
দেবেন্দ্রনাথ পরিবারের মধ্যে জমিদারির ভাগ-বাটোয়ারা নিজেই সম্পন্ন করেন। প্রথমদিকে বিরাহিমপুর ও কালীগ্রাম পড়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের ভাগে। পরবর্তীকালে জমিদারি পুনঃবিভাজিত হয়ে বিরাহিমপুর যায় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে সুরেন্দ্রনাথের অংশে, রবীন্দ্রনাথের থাকে শুধু কালীগ্রাম পরগণা যার প্রধান কার্যালয় ছিল বর্তমান নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার পতিসর নামক স্থানে।
পতিসর কালীগ্রাম পরগনার সদর দপ্তর। নওগাঁ, বগুড়া ও নাটোর জেলার ৬শ গ্রাম নিয়ে কালীগ্রাম পরগনা গঠিত। এর আয়তন ২৩০ বর্গমাইল। যা বরেন্দ্রভূমির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। কালীগ্রাম পরগনার রাতোয়াল আর ভান্ডারগ্রাম আরও দুটি সাব কাচারি ছিল। রাতোয়াল পতিসর থেকে ১০ কিলোমিটার আর ভান্ডারগ্রাম ২০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। কালীগ্রাম পরগনার সীমানা ছিল উত্তরে মালশন আদমদিঘি দক্ষিণে আত্রাই নদী, পূর্বে নাগর নদীর পশ্চিম তীর আর পশ্চিমে নাগর বিধৌত বাঁকা-কাশিয়াবাড়ী গ্রাম। দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, রাজশাহী, বগুড়া ও নওগাঁ জেলার বরেন্দ্রভূমি বিস্তৃত। আর এ বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলের একাংশ জুড়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের জমিদারি। জমিদারির পারিবারিক দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি বাংলার অপার স্নিগ্ধতাকে প্রেরণা করে তিনি সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী সব সাহিত্যকর্ম। বাংলার মাটিতে এই খন্ডকালীন সময়ে জমিদার রবীন্দ্রনাথ ও কবি রবীন্দ্রনাথ দুটি পৃথক চরিত্র হলেও দুটি অভিন্ন পরিচয়ে নিবিড়ভাবে ধরা পড়েছেন। প্রজাদের ভালো কর্মকাণ্ডে যেমন পদক্ষেপ রেখেছেন, তেমনি বিভিন্ন রচনায় সেই মানুষ ও প্রকৃতিকে তিনি ধারণ করেছেন।
পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত হয়ে জমিদারি দেখাশোনার জন্য রবীন্দ্রনাথ প্রথম পতিসর আসেন ১৮৯১ সালে এবং শেষবার ১৯৩৭ সালে। ১৯২১ সাল থেকে তিনি কেবল কালীগ্রাম পরগণারই জমিদার ছিলেন তিনি। প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছিল এই বাংলার বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে। তবে পতিসরে কবির আসা নিজের ইচ্ছায় ছিল না। অনেকটাই ভাগ্যক্রমে। সম্পত্তির সবশেষ ভাগে বিরাহিমপুর ও কালিগ্রাম পরগনার মধ্যে সত্যেন্দ্র পুত্র সুরেন্দ্রনাথকে তার পছন্দের অংশ বেছে নিতে বললে তিনি তখন বিরাহিমপুরকে পছন্দ করেন ফলে স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের অংশে এসে পরে কালীগ্রাম পরগনা যার সদর পতিসর।
প্রথমে পতিসর তার ভালো লাগেনি। কিন্তু পরবর্তীতে পতিসরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে কালীগ্রামের সহজ সরল প্রজা সাধারণের ভক্তি ও শ্রদ্ধা। এখানে এসে তিনি কৃষকদের খুব কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতে কৃষকের অর্থনীতি সম্পর্কে ভালো ধারণা জন্মেছিল। পতিসরের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল অগাধ ভালোবাসা, ছিল এখানকার মানুষের প্রতিও। তার বিচক্ষণতা দিয়ে প্রজাহৃদয় জয় করেছিলেন। তখন এ অঞ্চল ছিল একটি পিছিয়ে পড়া জনপদ। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত জমিদারি পরিচালনা পদ্ধতি চালু করেন। তিনি অনুন্নত পরগনার রাস্তাঘাট শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও দারিদ্র্য বিমোচনসহ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হাতে নেন। কর্মসূচির মধ্যে ছিল গ্রামে গ্রামে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি শিল্প, ব্যাংক স্থাপন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, কূপ, দিঘি ও পুকুর খনন, জঙ্গল পরিষ্কার, গ্রাম্য সালিশি ব্যবস্থা ও মহাজনের সুদের হাত থেকে দরিদ্র প্রজাদের রক্ষা করা। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য পরগনাকে ৩টি বিভাগে ভাগ করেন। কালীগ্রাম ‘হিতৈষী সভা’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। কালীগ্রাম পরগনার প্রজাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে পতিসর, রাতোয়াল ও কামতা তিন বিভাগে ৩টি মধ্য ইংরেজি (এমই) স্কুল ও পতিসরে ছেলে রথীন্দ্রনাথের নামে একটি হাইস্কুল স্থাপন করেন। স্কুলের ভবন, ছাত্রাবাস নির্মাণ ও অন্যান্য খরচ অ্যাস্টেট থেকে বহন করা হতো। পতিসরে অবস্থিত কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের প্রথমে নাম ছিল পতিসর এমই স্কুল। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে বিদ্যালয়টি হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয়। যেটি না বললেই নয়, যে এটি ছিল নওগাঁ জেলার তৃতীয় হাইস্কুল। ১৯১৩ সালের জানুয়ারি মাসে রাতোয়াল বিভাগে একটি বিদ্যালয় এবং কামতায় আরো একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি অনুভব করেন এ অঞ্চলের মানুষ অধিকাংশ কৃষক। আর এদের উন্নয়নের জন্য চাই কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়ন। সে জন্য বিলেত থেকে প্রথম এ অঞ্চলে কলের লাঙল আনেন এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করেন কবিগুরু। আর কৃষকদের উন্নতির জন্য শুরু করেন সমবায় পদ্ধতি ও এখানকার কৃষকের কল্যাণে তার নোবেল পুরস্কারের ১ লাখ ৮ হাজার টাকা দিয়ে তিনি পতিসরে একটি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। যাতে প্রজারা উন্নতির পাশাপাশি মহাজনদের সুদের হাত থেকে রক্ষা পায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারির কাজে প্রথম শাহজাদপুরে আসেন, ১৮৯০ সালে। শাহজাদপুর তখন বরেন্দ্র অঞ্চলের পাবনা জেলার অন্তর্গত সিরাজগঞ্জ মহকুমার একটি থানা, একেবারে নিভৃত পলি। চারদিকে নদ-নদী করতোয়া, বড়াল, গোহালা, হুড়োসাগর- অদূরেই বিশাল চলনবিল। নিভৃত এই উদার প্রকৃতিতে এসে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল প্রতিভা যেন পেয়ে গেল নতুন রসদ। শাহজাদপুর বসবাসকালে তিনি একের পর এক রচনা করেছেন উজ্জ্বল সব সাহিত্যকর্ম।
শাহজাদপুরে বসবাসকালে জমিদারি দেখভাল ও সাহিত্য রচনার পাশাপাশি সামাজিক অনেক কর্মকাণ্ডেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংশ্লিষ্ট হন। শাহজাদপুরের বাথানভূমির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের নাম। গরু চরানোর মাঠের অভাবের কথা চাষিদের কাছে শুনে রবীন্দ্রনাথ বুড়িপোতাজিয়া ও রামকান্তপুর মৌজার প্রায় ১২০০ একর জমি গোচারণের জন্য লাখেরাজ দান করেন। সে জমিতে এখনো বাথান আছে, আছে শত শত গরু। এই বাথানভূমির একটা অংশে, ২০০ একর জমিতে গড়ে উঠবে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথ যে গোচারণের জন্য জমি দিয়েছেন, শুধু তা নয়, উন্নত ভালো জাতের ষাঁড় এনে গাভি প্রজননের মাধ্যমে উন্নত গোসম্পদ সৃষ্টির ব্যবস্থা করেছেন। এখনো সেই গাভির জাত শাহজাদপুরে রয়েছে, যে গাভির দুধ দিয়ে চলছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘মিল্ক ভিটা’। শাহজাদপুরের জনপদ ও ভূপ্রকৃতিতে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
তথ্যসূত্র বিশ্লেষণ শেষে নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে যে বরেন্দ্র অঞ্চলের আধুনিকায়নে উন্নয়নের যে বিপ্লব শুরু হয়েছে তার রূপকার হচ্ছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
লেখা: আশরাফাফুল নয়ন, লেখক ও গল্পকার